বেগম খালেদা জিয়ার চট্টগ্রামগামী রোডমার্চ সম্পর্কে একটি পত্রিকার হেডলাইন ছিল ‘স্বতঃফূর্ত গণউচ্ছ্বাস’। এর মধ্য দিয়ে রোডমার্চের সত্যিকার তাৎপর্য ও ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে না। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞান-তাত্ত্বিকেরা পশ্চিমা নেতাদের উপদেশ দেন 'Educate your masters- তোমাদের প্রভুদের শিক্ষিত করে তোলো’। এর মাধ্যমে প্রথমত ভোটারদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করার কথা বলা হয়। কিন' সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই দেশের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসি'তি সম্পর্কে কার্যকর জ্ঞান লাভ করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তথ্যনির্ভরশীল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, এসব দেশের সাধারণ ভোটারও দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে কোনো গভীর জ্ঞান রাখেন না। যুক্তরাজ্যের একটি পার্লামেন্টারি ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল। আমি দেখেছি, নির্বাচনী প্রচারণার সময় সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা নিখুঁত বিশ্লেষণ করে সেগুলো জনগণের কাছে সহজবোধ্য করে তুলে ধরেন।
আমাদের দেশ অনেক সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যা আমাদের দেশের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোকের পক্ষে ঠিকমতো বোঝার কথা নয়। শেখ হাসিনা সরকার বিভিন্নভাবে এ সমস্যাগুলো জটিলতর করে তুলেছে। বেগম জিয়া তার দীর্ঘ তিন দশকের জনগণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক জীবনের মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন অসাধারণ বাগ্মী রূপে।
তিনি বিভিন্ন পথসভা ও জনসমুদ্রে তার দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমে জনগণকে এসব সমস্যা খুবই সহজ ভাষায় যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছেন।
তিনি প্রথমেই জনগণকে সরকারের কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস'া বিলোপ করায় অবাঞ্ছিত ফলাফলের কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের একদলীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং আমলাতন্ত্র চরম দলীয়করণ করার কারণে আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। দেশের বেশির ভাগ লোক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে কৃত্রিম নির্বাচনের আয়োজন করে শেখ হাসিনা ও এরশাদ ক্ষমতায় আসতে চান। জনগণ এই অশুভ পরিকল্পনা সার্থক হতে দেবে না।
বেগম খালেদা জিয়া সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না করে দলীয় সরকারের অধীনে ইলেকশন করলে বিএনপি ও আরো অনেক দল ইলেকশনে অংশ নেবে না। এই ইলেকশন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। দেশে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হবে। তাই জনগণের উচিত সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া পুনঃপ্রবর্তনের দাবি তুলে দেশে গণতন্ত্রের পথ সুসংহত করা।
এ ব্যাপারে আদালতের রায়ের কথা বলে শেখ হাসিনা জনগণের সাথে প্রতারণা করছেন। হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বাতিল করতে বললেও পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের কথা বলেছে।
এরপর বেগম জিয়া তার শ্রোতাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ কিভাবে ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হলো বেঁচে থাকার অধিকার (Right to live), যা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। হত্যা, গুম, অপহরণ, আত্মহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ এবার প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিটিয়ে বা গুলি করে হত্যা করছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ’৭২ থেকে ’৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সরকারি বাহিনী সিরাজ সিকদারসহ প্রায় ৪০ হাজার লোককে খুন করেছিল। বাংলাদেশে এখন সেই অবস'ার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
এরপর বেগম জিয়া দেশের অর্থনৈতিক পরিসি'তি সম্পর্কে আলোকপাত করেন। দ্রব্যমূল্যের অসহনীয়ভাবে বেড়ে চলার কথা বলেছেন। তিনি বললেন, কৃষকেরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। সরকারের সর্বস্তরে দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতিতে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি জড়িত আছেন বলেই তার সন্দেহ। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট পরিকল্পনা এবং বিদেশ থেকে বেশি দামে চাল আমদানি করে দলীয় সমর্থকের দুর্নীতি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের গুণ্ডামি, টেন্ডারবাজি, প্রশাসনের সর্বস্তরে রাজনীতিকরণ দেশকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
আমার কাছে বেগম জিয়ার ভাষণগুলোর সবচেয়ে গুরুত্ব অংশ মনে হচ্ছে দেশের অস্তিত্ব, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর তার বক্তব্যকে। তিন বছর ধরে ভারত আমাদের ওপর বিভিন্নমুখী আগ্রাসন চালাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে বেগম জিয়া এই প্রথম সমন্বিতভাবে তার বক্তব্য জনসমক্ষে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন।
এ কথা বেগম জিয়া নিশ্চিত জানেন, ভারতের মধ্য দিয়ে আসা আমাদের ৫৪টি নদীর পানি থেকে বঞ্চিত হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে না। তাই তিনি এই নদীগুলোর পানিতে আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এসব নদীর উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণের কঠোর প্রতিবাদ করেন। তিস্তা নদী নিয়ে চুক্তি না করার সমালোচনাও করেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে কোনো বাধা না দেয়ায় সরকারের ভূমিকার নিন্দা করেছেন।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তা হত্যা করে আমাদের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন এবং সত্যিকার অপরাধী ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন। তিনি বর্ডার গার্ড এবং সেনাবাহিনীতে নিয়ম ভাঙার অভিযোগ এনেছেন। তিন বছর ধরে ট্রানজিট ও করিডোরের নামে বাংলাদেশকে ভারতের একটি অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা জনতার কাছে উন্মুক্ত করে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশকে প্রলোভন দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে ভারত। বাংলাদেশে ভারতপন'ী লবি জনগণকে বোঝাতে চেয়েছে, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশকে ভারত যে কর দেবে তা দিয়ে সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে এ দেশ।
দিল্লি সফরে গিয়ে শেখ হাসিনা ভারতকে আগেই ট্রানজিট দেয়ার কথা স্বীকার করে আসেন। ঢাকায় মনমোহন-হাসিনা বৈঠকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে অনুমতি দেয়া হয় ভারতকে। সবশেষে বাংলাদেশের নদীর মধ্যে বাঁধ দিয়ে জলে-স'লে ভারতের এক সীমান্ত থেকে অপর প্রান্তে করিডোর দেয়া হয়েছে। সেই করিডোর তারা ব্যবহার করছে। এ জন্য বাংলাদেশের তিতাস নদীকে হত্যা করা হয়েছে।
ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ যেন একটি করদরাজ্যে পরিণত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেগম জিয়া এ কথাটি বারবার উল্লেখ করেছেন। তিনি জনগণকে বলেছেন, আমরা ভারতের করদরাজ্য হওয়ার জন্য স্বাধীন হইনি। তিনি ডাক দিয়ে বলেছেন করদরাজ্য বানানোর এই প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করতে হবে।
বেগম খালেদা জিয়া জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আরো জনসমাবেশ করার কর্মসূচি দিয়েছেন। এসব কর্মসূচি থেকে জনগণকে রাজনীতি সচেতন করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনীতির যেমন বিকাশ ঘটছে, একই সাথে তিনি প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের মানসকন্যায় পরিণত হয়েছেন।
লেখক : জাতীয় অধ্যাপক